রাষ্ট্রপতি অপসারণ সহজ হবে না: ঐক্যমত তৈরি
- আপলোড সময় : ৩০-১০-২০২৪ ১২:৫১:১৯ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ৩০-১০-২০২৪ ১২:৫১:১৯ পূর্বাহ্ন
সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্যের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল তার বিদায় চাইলেও সংবিধান অনুযায়ী তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হলে কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয় কি না সে শঙ্কাও করছেন রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে রাষ্ট্রপতি থাকবেন, নাকি থাকবেন না। এ বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যখন সিদ্ধান্ত হবে, তখন প্রক্রিয়াও ঠিক করা হবে। তবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি রাষ্ট্রপতির অপসারণ প্রশ্নে শক্তভাবে তাদের অবস্থান জানিয়ে দেওয়ায় এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি খুব সহজ হবে না। বরং বিএনপির সমমনা দলগুলোও তাদের পক্ষে থাকায় রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিষয়টি বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই বলে রাষ্ট্রপতির মন্তব্য সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবি তোলে। এ দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার অংশ হিসেবে বিএনপি, জামায়াতসহ ১২ দলীয় জোট ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন। গত ২৪ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা করা হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে রাষ্ট্রপতি থাকবেন, নাকি থাকবেন না। তাড়াহুড়া করা হবে না, আবার দীর্ঘদিন ঝুলেও থাকবে না। রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্রুত ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা চলছে, তারপরই সব বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেছেন, ১৯৯০ সালের কথা। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকার পতনের পর যখন প্রধান বিচারপতির পদে থাকা সাহাবুদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতির ইস্যুর সমাধান করা হবে। যেভাবে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে বিদায় করে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। যেসব দল নিয়ে আন্দোলন করা হয়েছে তাদের মধ্যে রাষ্ট্রপতির ইস্যু নিয়ে বিভক্তি হোক তা তারা চান না। তিনি বলেন, সংবিধানের অজুহাত তুলে রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যু জিইয়ে রাখা হয়েছে। এ সংবিধানের অজুহাত দেওয়া উচিত নয়। কারণ গণঅভ্যুত্থান-উপদেষ্টা পরিষদ গঠন সংবিধান মেনে হয়নি, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছে। রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যুও ঐকমত্যের ভিত্তিতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতি অপসারণে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। গত রোববার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের ফসলকে ঘরে তোলার জন্য বাংলাদেশের বিপ্লবকে যদি সংহত করতে হয়, তা হলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সবকিছু করতে হবে। তার জন্য বেশি প্রয়োজন অতিদ্রুত নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার শেষে নির্বাচন করা।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন বলেন, এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে এবং নির্বাচন বিলম্বিত হবে। সেটি তারা চান না। তবে বিএনপিসহ সব দল যদি বিষয়টিতে একমত হয়, তখন তারাও তা বিবেচনা করবেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনের থাকা বা না থাকা তাদের চাওয়ার বিষয় না। কারণ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এমনিতেই যথেষ্ট সংকটগ্রস্ত। এর মধ্যে দেশে কোনো সাংবিধানিক সংকট তৈরি হোক, এটি তারা চান না।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, রাষ্ট্রপতির বিষয়সহ আরও অনেক সংকট সামনে আসতে পারে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এখন পরিস্থিতি সামলাতে পারছে না। সে জন্য এখন রাষ্ট্রপতির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে নন তারা।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, সবাই একমত হলে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের কোনো প্রক্রিয়াতেই সংকট তৈরি হবে না। রাষ্ট্রপতি পদটির যেহেতু তেমন কোনো ক্ষমতা নেই, ফলে এই পদে কে থাকছেন না থাকছেন সেটি তাদের দেখার বিষয় নয়। তারা চান রাষ্ট্র সংস্কারের যে কাজগুলো আছে, সরকার সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে করুক।
নাগরিক অধিকার বিষয়ক সংগঠন সিটিজেন রাইটস মুভমেন্টের মহাসচিব তুসার রেহমান বলেন, রাষ্ট্রপতির অপসারণে রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির অপসারণ প্রশ্নে শক্তভাবে তাদের অবস্থান জানিয়ে দেওয়ায় এ বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। বরং ঐকমত্যের বিষয়টি বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। কিন্তু আবার সেটি পুরোপুরি অনুসরণও করা হচ্ছে না। বর্তমান রাষ্ট্রপতিই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদকে শপথ করিয়েছেন। তিনিই সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। যদি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সংসদ, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার সবাইকে বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয়তার নীতির বরাতে গণঅভ্যুত্থানের চেতনা নিয়ে সরকার গঠিত হতো, তা হলে আজকের সংকট দেখা দিত না। তখন রাষ্ট্রপতিকে পরিবর্তন করলেও বলা যেত যে জরুরি পরিস্থিতিতে জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হলে সংসদ না থাকায় সংবিধান অনুযায়ী নতুন কোনো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা যাবে না। ফলে বর্তমান রাষ্ট্রপতির অপসারণ সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক বা অস্থায়ী সরকার নির্বাচন করে নির্বাচিত সংসদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কোনো রূপরেখা দেখতে পাচ্ছি না, যে রূপরেখা বা ঘোষণা অনুযায়ী সরকারি ও শাসনতান্ত্রিক কর্মকা- পরিচালিত হতে পারে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কোনো রূপরেখা না থাকায় যে শাসনতান্ত্রিক বাধা-বিপত্তি তৈরি হচ্ছে, সেটি কেবল রাষ্ট্রপতির অপসারণে সুরাহা হবে বলে মনে হয় না। তবে বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে যদি অপসারণ করাই হয়, তা হলে সংসদ না থাকায় সংবিধান অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, শিক্ষক, আইনজীবী ও ছাত্র সংগঠনগুলোর কনভেনশন ডাকতে হবে। সেখানকার মতামতের ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, পরবর্তী সংসদে এর বৈধতা দেওয়া হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ